চাঁপাইনবাবগঞ্জ | সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১ info@mohanonda24.com +৮৮ ০১৬৮২ ৫৬ ১০ ২৮, +৮৮ ০১৬১১ ০২ ৯৯ ৩৩
আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারাকে আত্মহত্যার অন্যতম বড় কারণ হিসেবে দায়ী করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আশেক মাহমুদ।

হল কক্ষে ফাঁস দিয়ে রুয়েট শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা।

আ/স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশিত: ২১ মে ২০২৩ ১৭:১২

আ/স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশিত: ২১ মে ২০২৩ ১৭:১২

ফাইল ছবি

পুলিশ ও বিশ্ব বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, তানভীর দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের লেফটেন্যান্ট সেলিম হলের নিজ কক্ষে ফাঁস দেন। এ সময় কয়েকজন শিক্ষার্থী দেখে তাকে দ্রুত রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। যদিও কী কারণে তিনি আত্মহত্যা করেছেন তার রহস্য এখনও উদঘাটন হয়নি। শুধু এ শিক্ষার্থী নন, সারা দেশে ২০২২ সালে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ব বিদ্যালয় পর্যায়ের ৫৩২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন বলে বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশনের এক সমীক্ষায় উঠে এসছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আত্মহত্যাকারী স্কুল ও কলেজগামী শিক্ষার্থী-সংক্রান্ত তথ্যে জীবনে তাদের নানা ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার বিষয় উঠে এসেছে। সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে ‘মান-অভিমান’ থেকে। 

এতে আরও বলা হয়, আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৪০৫ জন বা ৭৬ দশমিক ১২ শতাংশই অপ্রাপ্তবয়স্ক। এর মধ্যে ৬৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ মেয়ে এবং ৩৪ দশমিক ৭ শতাংশ ছেলে। আর বিশ্ব  স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ বলছে, প্রতি বছর বিশ্বে যেসব কারণে মানুষের মৃত্যু ঘটে এর মধ্যে আত্মহত্যা ১৩তম প্রধান কারণ।
 
অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব মতে, ২০২০ সালের জরিপ প্রতি লাখে ৮ দশমিক ৫ জন আত্মহত্যা করেন। তাদের হিসাব বলছে, ওই বছরে সারা দেশে মোট ১৩ হাজার ৮১৪ জন মানুষ আত্মহত্যা করেন। এ হিসাবে গড়ে প্রতিদিন মারা যাচ্ছেন ৩৫ জন। আর আত্মহত্যার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের গড় প্রায় সমান। আর ২০১৯ সালে প্রতি লাখে আত্মহত্যার হার ছিল ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এতেই স্পষ্ট হয়, দেশে আত্মহত্যার হার দিন দিন বাড়ছে।
 
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মহত্যার প্রবণতা শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বেই বাড়ছে। কারণ নিজেকে যখন কেউ অপ্রয়োজনীয় মনে করেন, জীবন অর্থহীন মনে করেন তখন আত্মঘাতী হন। এ ছাড়া প্রযুক্তির অপব্যবহারের একাকিত্ব, নেতিবাচক চিন্তা-ভাবনা, আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কারণে মান-অভিমানে ফলে দিন দিন এ প্রবণতা বেড়েই চলেছে। আর আর্থিক ও সামাজিক বৈষম্য মানুষকে হতাশায় ফেলে দিচ্ছে এবং মানুষের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করছে। ফলে নানা ধরনের হতাশা থেকে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে।
 
 
আঁচলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রী ২৮৫ জন এবং ছাত্র ১৬১ জন। এর মধ্যে ৫৪ জন মাদরাসা শিক্ষার্থী। সমীক্ষায় পাওয়া তথ্য-উপাত্তে দেখা যাচ্ছে, ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সি শিক্ষার্থীদের মধ্যেই আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি।
আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারাকে আত্মহত্যার অন্যতম বড় কারণ হিসেবে দায়ী করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আশেক মাহমুদ। তিনি অনলাইন মাধ্যমে বলেন, বর্তমান সময়টা টেকনোলজি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আর প্রযুক্তির সঙ্গে জীবনযাপন এবং স্মার্ট ফোনের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার মানুষকে আবেগপ্রবণ করে। আর সবসময় স্মার্ট ফোন ব্যবহার করায় অন্যান্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক চর্চাগুলো বাধাগ্রস্ত হয়।
 
তিনি বলেন, আমাদের দুটি সমস্যা আছে। একটি হলো ব্যক্তির সমস্যা, অপরটি সমাজের। ব্যক্তির সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করার যে নিজস্ব সক্ষমতা তা ক্রমেই দুর্বল হয়ে গেছে। অপেক্ষা ও ধৈর্য ধরার যে কালচার তা দুর্বল হয়ে পড়েছে। এখন মানুষ সব বিনোদনের সামগ্রী হাতের কাছেই পাচ্ছে। 
ড. আশেক মাহমুদ বলেন, আগে সমাজে নিয়ন্ত্রণ করার যে সক্ষমতা ছিল সেটি এখন আর নেই এবং প্রযুক্তির কারণে তা অনেক কঠিন হয়ে গেছে। তখন কোনো ব্যক্তি সমস্যায় পড়লে সমাজ এগিয়ে আসত এবং গাইড লাইন দিত। এখন এসবের অনেক ঘাটতি। প্রযুক্তির কারণে মানুষ স্বনির্ভর। সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় না হওয়ায় আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তি তার সমস্যাগুলো অন্যের সঙ্গে শেয়ার না করে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
 
আত্মহত্যা রোধ করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রথমত সমাধান নিজেই বের করতে হবে। অল্প বয়সিদের হাতে মোবাইল দিয়ে দেওয়া হচ্ছে যা পারিবারিকভাবে আরও দেরি করা এবং নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। যত সাধারণ প্রযুক্তি ব্যবহার করবে ততই মঙ্গল। আর আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা এবং সহনশীলতার চর্চায় গুরুত্ব দিতে হবে। 
 
আত্মহত্যার কোনো সমাধান নেই উল্লেখ করে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ সময়ের আলোকে বলেন, চারদিকে সামাজিক অস্থিরতা বাড়ছে, আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। চাওয়া-পাওয়ার অপূণর্তা থেকে যাচ্ছে, বেকারত্ব ও দারিদ্র্যও রয়েছে। প্রযুক্তি মানুষকে যেমন সচেতন করে তেমনি আত্মহত্যাপ্রবণ করে। অর্থাৎ সবকিছু মিলিয়েই মানুষের মধ্যে এক ধরনের হতাশা তৈরি হচ্ছে। ফলে এসব নেতিবাচক ভাব-ভাবনার জন্য মানুষ আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে।
 
তিনি বলেন, কেউ যদি বলে আমি আত্মহত্যা করতে চাই; কী কারণে সে বলল, তার উৎস কী এবং কারণগুলো দ্রুত খুঁজে বের করতে হবে। আর যদি কোনো মানসিক সমস্যা থাকে সেটিও খুঁজে দেখতে হবে। কারণ মানসিক স্বাস্থ্যও যে শারীরিক স্বাস্থ্যের মতোই গুরুত্বপূর্ণ তা অনেকেই বুঝতে পারেন না। সেটিও চিহ্নিত করে খুব দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। আমাদের দেশে অনেকেই আত্মহত্যা করেছে মানসিক সমস্যার কারণে। চিকিৎসক তাকে ওষুধ খেতে বলেছেন কিন্তু খায়নি। তবে আত্মহত্যা বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে। আমাদের মানসিক রোগগুলোকে দ্রুত শনাক্ত করতে হবে।
 
মানুষের আত্মহত্যার নানামাত্রিক কারণ রয়েছে উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. একেএম রেজাউল করিম সময়ের আলোকে বলেন, জীবনকে অপ্রয়োজনীয় মনে করা, বেঁচে থাকা অর্থহীন, এ জীবন নিয়ে বেঁচে থেকে কী লাভ, নিজেকে অন্যের জন্য বোঝা মনে করা বা সীমাহীন কষ্টের কথা প্রকাশ করতে না পারাও আত্মহত্যার অন্যতম লক্ষণ। এই ধরনের হতাশা থেকেই সাধারণত মানুষ আত্মহত্যা করে। এ ছাড়াও প্রত্যেক মানুষের কিছু লক্ষ্য থাকে কিন্তু সে তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না। তখন এক ধরনের হতাশা তৈরি করে। মূলত আত্মহত্যার জন্য অন্যতম কারণ মানসিক রোগ ও বিষণ্নতা।
 
আত্মহত্যার প্রবণতা থেকে বের হওয়ার জন্য পারিবারিক বন্ধন আরও মজবুত করতে হবে। মানুষের মধ্যে মূল্যবোধ তৈরি করতে হবে। কারও সঙ্গে প্রতারণা করা যাবে না। আর কেউ যদি প্রতারণা করেও ফেলে তা হলে পরিবার, বন্ধু-বান্ধব ও আশাপাশের কমিউনিটিকে এগিয়ে আসতে হবে এবং সামাজিক নেটওয়ার্কে বৃদ্ধি করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। 


আপনার মূল্যবান মতামত দিন: